DON'T MISS
Home » Bangladesh » কীভাবে নির্ধারিত হয় তারকাদের পারিশ্রমিক

কীভাবে নির্ধারিত হয় তারকাদের পারিশ্রমিক

বাংলাদেশ টেলিভিশনে অভিনয়ের জন্য নিবন্ধন করে সি ক্যাটাগরির অভিনয়শিল্পী হিসেবে নাম লিখিয়েছিলেন আবুল হায়াত। প্রথম অভিনয় করে তিনি পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন ৯০ টাকা। চাইলেও বাড়তি পারিশ্রমিক দাবি করতে পারতেন না। নিয়মশৃঙ্খলার মধ্যে অভিনয়শিল্পীদের কাজ করে যেতে হতো। পারিশ্রমিক নিয়ে মান–অভিমান থাকত না, থাকত শিল্পচর্চায় নিজেকে এগিয়ে নেওয়ার প্রতিযোগিতা। কয়েক যুগ পর সেই পারিশ্রমিক নিয়েই এখন তর্কবিতর্কের শেষ নেই। কেমন ছিল পারিশ্রমিক বাড়ানোর একাল–সেকাল।

একটা সময় ছিল শুধু ভালোবেসেই অভিনয়শিল্পীরা কাজ করে গেছেন। সেখানে অর্থ ছিল গৌণ। পারিশ্রমিক নিয়ে সম্মান ও সন্তুষ্টি দুই থাকত। মুক্তিযুদ্ধ–পরবর্তী অভিনয়শিল্পীদের তিনটি গ্রেডে পারিশ্রমিক নির্ধারিত হতো। চাইলেই কেউ সি গ্রেড থেকে এ গ্রেডে যেতে পারতেন না। অভিনয়শিল্পী হিসেবে সি ক্যাটাগরি দিয়ে শুরু হতো পারিশ্রমিক। এর মধ্যে বিশেষ অভিনয়দক্ষতা ও অভিনয়ের অভিজ্ঞতা দিয়ে কেউ কেউ জায়গা পেতেন স্পেশাল ও এক্সক্লুসিভ ক্যাটাগরিতে। আবুল হায়াত বলেন, ‘আমরা নিবন্ধন করেই অভিনয়শিল্পী হিসেবে সম্মানজনক পারিশ্রমিক পেতাম। পরবর্তী সময়ে টাকার মান কমতে থাকলে টেলিভিশন পারিশ্রমিক সমন্বয় করে। বাংলাদেশ টেলিভিশনে নিয়মনীতি, শৃঙ্খলার মধ্যে থাকতে হতো। বেসরকারি টেলিভিশন আসার পর অভিনয়শিল্পীরাই ইচ্ছেমতো পারিশ্রমিক নির্ধারণ করতে থাকেন।’

বেসরকারি টেলিভিশনের যাত্রা শুরু হওয়ার পর তারকারা নিজেরাই নিজেদের পারিশ্রমিক নির্ধারণ করতেন। এই সময় নাটকের বাজেট, সংখ্যা ও তারকাদের কাজের পরিসর বাড়তে থাকে। যে কারণে বিটিভিতে অভিনয় করে জনপ্রিয়তা পাওয়া জাহিদ হাসান, তৌকীর আহমেদ, আজিজুল হাকিম, শহীদুজ্জামান সেলিম, টনি ডায়েস, মাহফুজ আহমেদ, শমী কায়সার, বিপাশা হায়াত, আফসানা মিমিসহ বেশ কিছু তারকার চাহিদা ছিল সবচেয়ে বেশি। চাহিদার কারণে তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ পারিশ্রমিক বাড়িয়েছেন। নব্বইয়ের দশক থেকেই নিয়মিত পরিচালনা করে আসছেন মোহন খান।

এই নির্মাতা বলেন, ‘সেই সময় কাজের বৈচিত্র্য এখনকার মতো এতটা ছিল না। তারকারা পারিশ্রমিক বাড়ালেও কোনো কম্প্রোমাইজ না করেও কাজ করা যেত।’ বর্তমান সময়ে দেখা যায়, কেউ কেউ বছরে দুবারের বেশি পারিশ্রমিক বাড়ান। অতিতে পারিশ্রমিক কীভাবে বাড়তেন তারকারা, এমন প্রশ্নে মোহন খান বলেন, ‘এখন তো সরাসরি কিছু তারকা বলেই বসেন আগের চেয়ে পারিশ্রমিক বাড়িয়েছেন। অন্যদিকে নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে কিছু তারকা বছরে বছরে পারিশ্রমিক বাড়িয়েছেন। কিন্তু পারিশ্রমিক বাড়াতে চাওয়ার ভাষা ছিল আলাদা। কেউ হয়তো বলতেন, “ভাই, আমি এবার ঈদের জন্য তিনটা কাজ করে ফেলেছি, আর করতে চাইছি না।” তখন বুঝে ফেলতাম, পারিশ্রমিক বাড়াতে চাচ্ছেন।’
২০০০ সাল–পরবর্তী সময়ে নাটক ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। নতুন নতুন চ্যানেল বৈচিত্র্যপূর্ণ নাটক নিয়ে হাজির হতে থাকে। তরুণেরা অভিনয়কে পেশা হিসেবে নিতে শুরু করেন। এই সময়ে হু হু করে বাড়তে থাকে বেসরকারি চ্যানেলের সংখ্যা। নাটকে যোগ হয় টিআরপি সিস্টেম। তখন জানা যেত কোন অভিনয়শিল্পীর নাটক বেশি দেখছেন দর্শক। সেই হিসাবে দর্শকদের চাহিদার তুঙ্গে ছিলেন লিটু আনাম, ইন্তেখাব দিনার, মীর সাব্বির, আনিসুর রহমান মিলন, শাহরিয়ার নাদিম জয়, অপি করিম, তারিন, ঈশিতা, শ্রাবন্তী প্রমুখ। এই দশকের শেষের দিকে মোশাররফ করিম, চঞ্চল চৌধুরী, অপূর্ব, নুসরাত ইমরোজ তিশাসহ বেশ কিছু তারকা অভিনয় দিয়ে আলোচনায় আসেন। তাঁরা নিজেদের মতো চাহিদা বিবেচনায় পারিশ্রমিক বাড়াতে থাকেন। সালাহউদ্দিন লাভলু বলেন, ‘২০০২ সাল–পরবর্তী টিআরপি সিস্টেম চালু হওয়ার কারণে জানা যেত দর্শক কোন অভিনয়শিল্পীদের নাটক দেখছেন। তখন টেলিভিশন থেকে সেই অভিনয়শিল্পীদের নাটক বেশি চাওয়া হতো। তবে তখনো নির্মাতা, প্রযোজকদের কাস্টিংয়ের ব্যাপারে স্বাধীনতা ছিল। সেই সময় পারিশ্রমিক বাড়লেও এখনকার মতো সেটা হুট করে দ্বিগুণ নয়।’

২০১০ সালের আগে তারকারা পারিশ্রমিক বাড়ালেও সেটা থাকত ৫ থেকে ১০ হাজারের মধ্যে। সালাহউদ্দিন লাভলুর মতে, পরবর্তী সময়ে ইউটিউবের দৌরাত্ম্যে নতুন অভিনয়শিল্পীরা তাঁদের পারিশ্রমিক রাতারাতি বাড়িয়ে দিতে শুরু করেন। কোণঠাসা হয়ে পড়েন অনেক গুণী অভিনয়শিল্পী। বাধ্য হয়েই তখন টেলিভিশনগুলো শিল্পীদের পারিশ্রমিক বাড়ানো শুরু করে। ২০১৫ সালের পরে ভিউ হয়ে ওঠে শিল্পীদের পারিশ্রমিকের মানদণ্ড। যে তারকার যত ভিউ, তাঁর তত পারিশ্রমিক। মোশাররফ, অপূর্ব, আফরান নিশো, মেহজাবীন চৌধুরী, তৌসিফ, জোভান, তানজিন তিশা, মুশফিক ফারহান, ফারিণসহ এই সময়ের একাধিক অভিনয়শিল্পী নিয়মিত নিজেরাই পারিশ্রমিক বাড়াতে থাকেন। ২০২০ সালে প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘এক নাটকের ৭০ ভাগ টাকা নিয়ে যাচ্ছেন দুই শিল্পী’। সেসব তারকার গত তিন বছরে পারিশ্রমিক চার থেকে সাত গুণ পর্যন্ত বেড়েছে।

অভিনেতা আবুল হায়াত মনে করেন, চাহিদা থাকলে পারিশ্রমিক বাড়াতেই পারেন। কারণ, এখানে কোনো নিয়ম নেই। তবে তিনি শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ‘পেশাগত জায়গায় শিল্প ও বাণিজ্য একসঙ্গে হওয়ার পর থেকে শিল্প সব সময়ই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারপরও আমাদের মধ্যে প্যাশনটা ছিল। কিন্তু এখন শিল্পের চেয়ে বাণিজ্য বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে। কেউ অভিনয়কে শতভাগ বাণিজ্যিকভাবে দেখেছেন। কেউ বাণিজ্য–শিল্প দুটোই করছেন। তাঁদের কেউ পারিশ্রমিক ইচ্ছেমতো চেয়েই পাচ্ছেন, অন্যরা সেই তুলনায় দুই টাকা বেশি চাইলে প্রযোজকেরা পেয়ে বসেন। এভাবে দিন দিন শিল্পচর্চার প্রতি ভালোবাসা কমছে। মানহীন কাজ বেড়েই চলেছে।’


নব্বইয়ের দশকের জনপ্রিয় একজন তারকা বলেন, ‘বেসরকারি টেলিভিশন আসার পর যাঁদের চাহিদা ছিল, তাঁরা নিজেদের পারিশ্রমিক নিয়েছেন। আবার টেলিভিশন যখন নির্মাতাদের বাজেট বেশি দিয়েছেন, অভিনয়শিল্পীরা সেই বাড়তি অংশ কিন্তু পাননি। পারিশ্রমিক নিয়ে তর্কবিতর্ক সব সময়ই ছিল। কিন্তু আমরা শিল্পচর্চাকে প্রাধান্য দিয়েছি। কারণ, প্রজন্মের পর প্রজন্ম বাংলা নাটক দেখে বড় হয়েছে, একসময় তরুণদের বেড়ে ওঠার ওপর নাটক অনেক বড় প্রভাব ফেলত। এসব মাথায় রেখে আমরা কাজ করতাম। অথচ আজ কিছু শিল্পীর ব্যবসায়িক মানসিকতার কারণে সেই নাটক সমাজ থেকে বিচ্যুত।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*