DON'T MISS
Home » Bangladesh » তাদের সর্বনাশ যখন আমাদের চোখে ‘সামান্য ক্ষতি’

তাদের সর্বনাশ যখন আমাদের চোখে ‘সামান্য ক্ষতি’

ঘূর্ণিঝড় মোখার আঘাতে বিধ্বস্ত হাসিনা বেগমের ঘর। সেখান থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র উদ্ধারে ব্যস্ত তিনি। গত সোমবার সেন্ট মার্টিনের দক্ষিণ পাড়ায়।

ঘূর্ণিঝড় মোখার আঘাতে বিধ্বস্ত হাসিনা বেগমের ঘর। সেখান থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র উদ্ধারে ব্যস্ত তিনি। গত সোমবার সেন্ট মার্টিনের দক্ষিণ পাড়ায়।

আসি আসি বলে মোখা আসেনি। চলে গেছে আরাকানে, এখন যাকে রাখাইন বলা হয়। মিয়ানমারের সেই রাজ্যে মোখা এখন শান্ত।

আমাদের হিস্যায় বলা চলে সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড় নয়, একটু ঝড় হয়েছে। তবে একেবারেই ক্ষতিহীন ছিল না এই ঝড়। ক্ষতি হয়েছে সাধারণ গরিব মানুষের। তাঁদের টিনের চাল খুলে পড়েছে। ‘ভুল’ গাছের (বিদেশি জাতের) ডাল ভেঙেছে। ঝুনা নারকেলের আঘাতে সেন্ট মার্টিনে একজন আহত হয়েছেন। বলা হচ্ছে, জান বাঁচলেও সেন্ট মার্টিন, টেকনাফ আর শাহ পরীর দ্বীপের মানুষের অর্থনীতি আবার চাঙা হতে সময় লাগবে। ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয়েছেন কেউ কেউ।

নিম্নবিত্তদের কাঁচা ঘরবাড়ি একেবারে বিধ্বস্ত হয়ে গেছে এই ঝড়ে। এখন পর্যন্ত অভিজ্ঞতা আর চোখের আন্দাজ অনুযায়ী সব মিলিয়ে ঝড়ের প্রভাবের শিকার হয়েছেন প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ (কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের হিসাবে দুর্গত ৩ লাখ ৩৪ হাজার ৬২০ জন)। তাঁদের কেউ গৃহহীন হয়েছেন, কেউ কাজের সুযোগ হারিয়েছেন। জীবিকা স্থগিত হয়েছে অনেকের।

নিম্নবিত্তের মানুষের ক্ষতিকে ‘সামান্য’ হিসেবে দেখার একটা বিলাসিতা আছে আমাদের। রবীন্দ্রনাথের ‘সামান্য ক্ষতি’ কবিতার করুনারা এখন আর গরিবের পক্ষে কথা বলার চেষ্টাও করেন না।

‘সামান্য ক্ষতি’ প্রতিরোধ করা যেত কি

কক্সবাজার জেলা প্রশাসন প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে ঘূর্ণিঝড় মোখার আঘাতে প্রায় ২ হাজার ঘরবাড়ি পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়েছে। আর ১০ হাজার ঘরবাড়ি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এটা ‘প্রচণ্ড শক্তিতে ধেয়ে’ আসা মোখার সম্ভাব্য তাণ্ডবের তুলনায় অতিসামান্য ক্ষতি’। কিন্তু যার গেছে, তাঁর এটা সামান্য ক্ষতি বা দ্রুত নিরাময় যোগ্য ক্ষত নয়।

দেশের বাইরের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড়ের অস্তিত্ব আর তার প্রায় সঠিক গতিবিধির খবর দিচ্ছিলেন কমপক্ষে দিন কুড়ি আগে থেকে। বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তর অবশ্য লঘুচাপ তৈরি না হওয়া পর্যন্ত বিষয়টি আমলে নেয় না। ঘূর্ণিঝড়, লঘুচাপ, নিম্নচাপ ইত্যাদির বাইরেও বৈশাখ থেকে আশ্বিন আমাদের ঝড়ের মাস। ঝড়ের মাসগুলোকে সামনে রেখে কাঁচা ঘরের খুঁটি পাল্টানো, অতিরিক্ত টানা দিয়ে ঘরটাকে ঝড়ে টিকে থাকার মতো মজবুত বা ইঞ্জিনিয়ারদের ভাষায় ‘রি ইনফোর্স ‘করার চর্চা অনেক দিনের।

১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল আঘাত হানা প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের পর অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী ও অধ্যাপক আইনুন নিশাত উপকূলের মানুষদের আবাস চর্চা নিরীক্ষা করতে কুতুবদিয়ায় গিয়েছিলেন। সেখানে মানুষের নানা কৌশলের সঙ্গে পরিচিত হন তাঁরা। দুজনেই মানুষের এই অভিজ্ঞতাপ্রসূত জ্ঞানের কদর করতেন। ঘরের চালার সঙ্গে অতিরিক্ত টানা দেওয়া বা ‘রি–ইনফোর্স ‘খুবই বিজ্ঞানসম্মত প্রকৌশলব্যবস্থা। নির্মাণ প্রকৌশলবিদ্যার অন্তর্ভুক্ত এই কাজটি সাধারণ মানুষ রপ্ত করেছেন স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ঝড়বৃষ্টির সঙ্গে বসবাস করতে করতে।

মোখার কারণে মহেশখালীর ভাসমান এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) টার্মিনাল থেকে গ্যাসের সরবরাহ বন্ধ থাকায় চট্টগ্রামের সর্বত্র সংকট তৈরি হয়। ঘূর্ণিঝড় নিয়ে সতর্কতার মুখে টার্মিনাল মহেশখালীর নির্ধারিত জায়গা থেকে গভীর সমুদ্রের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকেই গ্যাস–সংকটের শুরু। পরিস্থিতি এখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি।

ঘূর্ণিঝড় নিয়ে প্রচার

ঘূর্ণিঝড়ের ইঙ্গিত আসার সঙ্গে সঙ্গে যদি মানুষকে জানানো যেত, আর বলা হতো, আসন্ন ঝড়ের জন্য ঘরবাড়িগুলোকে মজবুত করুন, দরকার হলে খুঁটি পাল্টান, ঘরের টানাগুলো ঠিক করুন, ঝুনা নারকেলগুলো পেড়ে রাখুন, তাহলে উপকার পাওয়া যেত।

ঝড় শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেন্ট মার্টিনে ঘরের ছাউনির টিন উড়ে যাওয়ার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। ঘরগুলো নিয়মমাফিক মজবুত করে তৈরি আর রক্ষণাবেক্ষণ করলে এমনটি হতো না। বাতাসের গতি কালবৈশাখীর কাছাকাছি থাকায় এই টিনগুলো উড়ন্ত তলোয়ার হয়নি, কিন্তু হতে পারত। ১৯৯১ সালে হয়েছিল। তখন সিদ্ধান্ত হয়েছিল, উপকূল অঞ্চলে অনিয়ন্ত্রিতভাবে টিনের ঘর আর তৈরি করতে দেওয়া হবে না। বলাবাহুল্য, ঢেউ টিন কোম্পানির মালিকদের সঙ্গে কেউ আর বিতর্কে জড়াতে চায়নি।

এর মধ্যে টিন রেখে ঝড়–সহনীয় ঘর নির্মাণের প্রযুক্তি পরীক্ষায় টিকে গেছে। ঢেউটিন জয়যুক্ত হয়েছে। তবে চর্চায় যে নেই, সেটি দেখা গেল টেকনাফ, সেন্ট মার্টিন ও শাহপরীর দ্বীপে। যে কায়দায় উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবিরগুলো ঝড়ের আগে শক্তপোক্ত করা হয়, সেই একই কৌশলে দড়ি, বাঁশ ও তার দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোর ঘরবাড়ি সুরক্ষার ব্যবস্থা করা যেত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*