অমৃতসরে স্বর্ণমন্দির থেকে বের হচ্ছেন অমৃতপাল সিং, মার্চ ২০২৩। ছবি : সিএনএন
কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতি এবং কানাডার মাটিতে এক শিখ আন্দোলনকারীকে হত্যার ঘটনায় ভারত সরকারের জড়িত থাকার অভিযোগ নিয়ে কানাডা ও ভারতের মধ্যে উত্তেজনা নতুন উচ্চমাত্রায় পৌঁছেছে।
শিখদের স্বাধীনতা বা খালিস্তান আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এমনটা ঘটেছে। ভারত বারবার কানাডাকে এই আন্দোলনকে সমর্থন জোগানোর জন্য অভিযুক্ত করেছে। এ আন্দোলন ভারতে নিষিদ্ধ হলেও শিখ প্রবাসীদের মধ্যে সমর্থন রয়েছে।
খালিস্তান আন্দোলন কী?
ভারতের শিখ স্বাধীনতা আন্দোলন বর্তমানে একটি রক্তাক্ত সশস্ত্র বিদ্রোহে পরিণত হয়েছে যা ১৯৭০-৮০’র দশকে ভারতকে নাড়া দিয়েছিল। প্রথমে এ আন্দোলন উত্তর পাঞ্জাব রাজ্যে কেন্দ্রীভূত ছিল, যেখানে শিখরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। যদিও ভারতের জনসংখ্যার প্রায় ১.৭% শিখ।
এক দশকেরও বেশি সময় ধরে শিখদের বিদ্রোহ চলে। ভারতীয় সরকার এ বিদ্রোহ কঠোরভাবে দমন করেছিল। এ সময় শিখ নেতাসহ হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছিল। অনেককে আটকে রাখাও হয়। অধিকারবিষয়ক গ্রুপগুলোর মতে মিথ্যা বন্দুকযুদ্ধের মাধ্যমেও হত্যাকাণ্ড ঘটে।
১৯৮৪ সালে ভারতীয় সেনাবাহিনী অমৃতসরের শিখ ধর্মের পবিত্রতম উপাসনালয় স্বর্ণ মন্দিরে অভিযান চালায়। এ সময় সেখানে আশ্রয় নেওয়া বিচ্ছিন্নতাবাদীদের তাড়িয়ে দেয় তারা। সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে এই অভিযানে প্রায় ৪০০ জন নিহত হয়। তবে শিখ দলগুলো বরাবরই বলে আসছে এসব হামলায় নিহতের সংখ্যা অনেক বেশি।
নিহতদের মধ্যে শিখ নেতা জার্নাইল সিং ভিন্দ্রানওয়াল ছিলেন। তার বিরুদ্ধে ভারত সরকার সশস্ত্র বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগ জানায়।
মন্দিরে অভিযানের প্রতিশোধ নিতে ইন্দিরা গান্ধীকে ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর তার দুই দেহরক্ষী হত্যা করে, যারা ছিল শিখ।
তার মৃত্যু ঘিরে ধারাবাহিক শিখ বিরোধী দাঙ্গার সূত্রপাত ঘটে। এ সময় উত্তেজিত হিন্দু জনতা উত্তর ভারতে, বিশেষ করে নয়াদিল্লিতে প্রায় প্রত্যেক ঘরে গিয়ে শিখদের বাড়ি থেকে টেনে বের করে নিয়ে যায়। এসব ঘটনায় অনেকে প্রাণ হারায়।
আন্দোলন কি এখনো সক্রিয়?
বর্তমানে পাঞ্জাবে কোনো সক্রিয় বিদ্রোহ নেই, কিন্তু এখনও রাজ্যে খালিস্তান আন্দোলনের কিছু সমর্থক রয়েছে। সেই সাথে ভারতের বাইরেও বিশাল শিখ প্রবাসী গোষ্ঠী রয়েছে। শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ফিরে আসার চেষ্টা করছে বলে ভারত সরকার কয়েক বছর ধরে বারবার সতর্ক করে আসছে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকারও শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের তাড়িয়ে দেওয়া জোরদার করেছে এবং আন্দোলনের সাথে যুক্ত বিভিন্ন সংগঠনের কয়েক ডজন নেতাকে গ্রেপ্তার করেছে।
২০২০ সালে কৃষকরা যখন বিতর্কিত কৃষি আইনের প্রতিবাদ করতে নয়াদিল্লির বিভিন্ন প্রান্তে আন্দোলন করে তখন মোদি সরকার শিখ অংশগ্রহণকারীদের ‘খালিস্তানি’ বলে অভিহিত করার চেষ্টা করে। পরে চাপের মুখে পড়ে মোদি সরকার আইন প্রত্যাহার করে নেয়।
চলতি বছরের শুরুর দিকে ভারতীয় পুলিশ এক বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাকে গ্রেপ্তার করে। তিনি খালিস্তানের দাবি পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন এবং পাঞ্জাবজুড়ে সহিংসতার আশঙ্কা জাগিয়েছিলেন। অমৃতপাল সিং নামে ৩০ বছর বয়সী এ আন্দোলনকারী জ্বালাময়ী বক্তৃতার মাধ্যমে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি বলেন, ভিন্দ্রানওয়ালের কাছ থেকে তিনি অনুপ্রেরণা পেয়েছেন।
ভারতের বাইরে এ আন্দোলন কতটা শক্তিশালী?
কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলোর কাছে শিখ কর্মীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেছে ভারত। নরেন্দ্র মোদি ব্যক্তিগতভাবে দেশগুলোর প্রধানমন্ত্রীদের কাছে বিষয়টি উত্থাপন করেছেন। কানাডার সাথে ভারত বিশেষ করে এ উদ্বেগ উত্থাপন করেছ, যেখানে শিখরা দেশের জনসংখ্যার প্রায় দুই শতাংশ।
এ বছরের শুরুর দিকে শিখ বিক্ষোভকারীরা লন্ডনে ভারতীয় হাইকমিশনে দেশের পতাকা টেনে নামিয়ে দেয় এবং অমৃতপাল সিংকে গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে ব্যাপক ক্ষোভ প্রদর্শন করে। এ সময় বিক্ষোভকারীরা সান ফ্রান্সিসকোতে ভারতীয় কনস্যুলেটের জানালা ভেঙে দেয় এবং দূতাবাসের কর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ ঘটনার নিন্দা করেছে। লন্ডনে দূতাবাসে নিরাপত্তা লঙ্ঘনের ঘটনায় নয়াদিল্লিতে যুক্তরাজ্যের ডেপুটি হাইকমিশনারকে তলব করা হয়েছে।
ভারতীয় সরকার খালিস্তান আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে কানাডায় হিন্দু মন্দির ভাঙচুরের অভিযোগ তোলে। এসময় গ্রাফিতি আঁকা হয় এবং ভারত বিরোধী স্লোগান দেওয়া হয়। মার্চে অটোয়ায় ভারতীয় হাইকমিশনে হামলার অভিযোগও ওঠে।
গত বছর পাকিস্তানে খালিস্তান কমান্ডো ফোর্সেসের প্রধান শিখ সংগ্রামী নেতা পরমজিত সিং পঞ্জয়ারকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
শেখ সালেক : ভারত প্রতিনিধি, আ্যসোসিয়েট প্রেস।
ভাষান্তর : সরকার জারিফ।