জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জছবি : রয়টার্স
ধরুন, যুক্তরাজ্যে বসবাসরত একজন অস্ট্রেলীয় প্রকাশকের বিরুদ্ধে কিউবা তাদের সামরিক বাহিনীর অপরাধ ফাঁস করার অভিযোগ করল এবং তাঁকে কিউবার হাতে তুলে দিতে যুক্তরাজ্য সরকারকে অনুরোধ করল।
ধরুন, কিউবার সামরিক বাহিনী ২০০৭ সালে হেলিকপ্টার থেকে ইরাকের মাটিতে বোমা ফেলে ও গুলি চালিয়ে রয়টার্সের দুই সাংবাদিকসহ কয়েক ডজন ইরাকিকে মেরে ফেলেছিল এবং ওই প্রকাশক সে–সংক্রান্ত তথ্য–উপাত্ত ছাপিয়েছিলেন।
এবার কল্পনা করুন, যদি ওই প্রকাশককে যুক্তরাজ্য থেকে কিউবায় হস্তান্তর করা হয়, তাহলে একজন পেশাদার সংবাদ প্রকাশকের দায়িত্ব পালন করার কারণে তাঁর পৌনে দুই শ বছর জেল হতে পারে।
সবশেষে, যুক্তরাজ্যের প্রতি কিউবার এই আবেদনে যুক্তরাষ্ট্র কী প্রতিক্রিয়া দিতে পারে, তা কল্পনা করে দেখুন। মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের পক্ষে চির-সোচ্চার যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে কিউবার এই কাজের নিন্দা জানাতে সারা বিশ্বকে আহ্বান জানাবে, তা কল্পনা করে দেখুন।
এটি আন্দাজ করা নিশ্চয়ই খুব কঠিন হচ্ছে না, ওপরে যা যা কল্পনা করতে বলা হলো, তা আসলে একটি বাস্তব ঘটনারই নতুন করে সাজিয়ে বলা একটি রূপ এবং সেই প্রকাশক হলেন উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ।
বাস্তবে, প্রকাশককে নিজের হাতে তুলে দিতে অনুরোধ করা সেই দেশটি কিউবা নয়, বরং খোদ যুক্তরাষ্ট্র, যে দেশটি কিনা শুধু জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের ব্যক্তিগত মানবাধিকারকেই পিষে মারেনি; সারা বিশ্বে বিপুলসংখ্যক মানুষের ওপর নৃশংস আক্রমণ করে আসছে।
দীর্ঘদিন কারাগারে আটকে রেখে তীব্র মানসিক নির্যাতন করে ধীরে ধীরে ‘হত্যা’ করার যে ধারণা প্রচলিত আছে, সেই ধারণাকে আরও স্বাভাবিক করে তোলার জন্য অ্যাসাঞ্জকে ‘অনন্তকালের চেয়েও বেশি’ সময় কারাগারে রাখার ধারণা তৈরি করা হয়েছে। তবে অ্যাসাঞ্জের চূড়ান্ত পরিণতি যা–ই হোক না কেন, তাঁর সঙ্গে ইতিমধ্যেই যে আচরণ করা হয়েছে, তা শুধু বাক্ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকেই অপরাধীকরণের বিপজ্জনক নজির স্থাপন করেনি, এটি আপনার চিন্তার স্বাধীনতাকেও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এই সত্যটি অবশ্যই বুঝতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ, অ্যাসাঞ্জের উইকিলিকস ইরাক, আফগানিস্তান এবং অন্যত্র মানুষের জীবনকে বিপন্ন করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ভাষ্য শুনে মনে হতে পারে, ইরাক–আফগানিস্তানের মতো জায়গায় জীবনকে বিপন্ন না করার একটি মোক্ষম উপায় হলো, প্রথম সুযোগেই তাদের বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়া (যে কাজটি তারা এত দিন করে এসেছে)।
অ্যাসাঞ্জ যদি নিজের চামড়া বাঁচাতে চাইতেন, তাহলে তিনি এমন সাম্রাজ্যবাদী প্রোপাগান্ডায় নিজেকে আটকে থাকতে পারতেন, যা মূলধারার সাংবাদিকতা হিসেবে পরিচিত এবং এটি এমন একটি ক্ষেত্র, যা আফগানিস্তান যুদ্ধ ও ইরাক যুদ্ধকে মার্কিন জনগণের কাছে নিজেরাই বিক্রি করে দিয়েছিল। তার বদলে তিনি দক্ষিণ–পূর্ব লন্ডনের বেলমার্শ কারাগারে বন্দী অবস্থায় থাকছেন এবং তথাকথিত ‘স্বাধীনতার ভূখণ্ড’ আমেরিকায় হস্তান্তরিত হওয়ার জন্য নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে অপেক্ষা করছেন।
রাজা চার্লসের সাম্প্রতিক রাজ্যাভিষেক সামনে রেখে তাঁর উদ্দেশে একটি চিঠিতে অ্যাসাঞ্জ নিজেকে একজন ‘রাজনৈতিক বন্দী’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। সেই চিঠিতে তিনি রাজাকে বলেছেন, ‘একটি সমাজ তার বন্দীদের সঙ্গে কেমন আচরণ করে, তা থেকে ওই সমাজ সম্পর্কে জানা যায় এবং আপনার রাষ্ট্র অবশ্যই এই ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ হয়েছে।’