DON'T MISS
Home » UK NEWS » Bangladesh politics » মুক্ত গণমাধ্যম সূচক: ১৪ বছরে ৪২ ধাপ পেছাল বাংলাদেশ

মুক্ত গণমাধ্যম সূচক: ১৪ বছরে ৪২ ধাপ পেছাল বাংলাদেশ

২০১৬ সাল ছাড়া এই সূচকে ধারাবাহিকভাবে প্রতিবছরই অবনতি হয়েছে বাংলাদেশের।

আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর টানা ৩ মেয়াদে ক্ষমতায় আছে। এই ১৪ বছরের শাসনামলে মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে ৪২ ধাপ পিছিয়েছে বাংলাদেশ।

মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে ২০০৯ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২১তম এবং ১০০ এর মধ্যে বাংলাদেশের স্কোর ছিল ৪২ দশমিক ২। গত বছর মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৬২তম এবং স্কোর ছিল ৩৬ দশমিক ৬৩।

আজ বুধবার প্রকাশিত সূচকে দেখা যায়, ২০২৩ সালে আরও একধাপ পিছিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান হয়েছে ১৬৩তম। এ বছর বাংলাদেশের স্কোর ৩৫ দশমিক ৩১।

রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্রস (আরএসএফ) প্রতিবছর ১৮০টি দেশ ও অঞ্চলের মধ্যে থেকে এই বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচক প্রকাশ করে। আরএসএফের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, তারা ২০০২ সাল থেকে এই সূচক প্রকাশ করছে।

বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচক তৈরিতে আরএসএফ মূলত ৫টি বিষয় বিবেচনায় নেয়। সেগুলো হলো—রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, আইনি অবকাঠামো, অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট, সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট ও নিরাপত্তা।

২০ বছরের ইতিহাসে গত বছর বাংলাদেশ সবচেয়ে কম স্কোর পেয়ে ১৬২তম অবস্থানে পৌঁছে। এ বছর আরও অবনতি হয়ে পৌঁছেছে ১৬৩তম অবস্থানে। ২০০৯ সালের পর থেকে ২০১৬ সাল ছাড়া বাংলাদেশ কখনই গণমাধ্যম সূচকে উন্নতি করতে পারেনি। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ২০১৫ সালের তুলনায় ২ ধাপ উন্নতি করে ১৪৪তম অবস্থানে ছিল। পরের বছর অর্থাৎ ২০১৭ সালে আবার ২ ধাপ অবনতি হয়ে বাংলাদেশের অবস্থান হয় ১৪৬তম। ২০১৮ সালে বাংলাদেশের অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। ২০১৯ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৫০তম। পরের বছর এটি ১৫১তম হয়, ২০২১ সালে ১৫২তম এবং ২০২২ সালে ১০ ধাপ পিছিয়ে হয় ১৬২তম।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সূচক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০০৯ সাল থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে কখনো তাদের উন্নতি হয়েছে, আবার কখনো অবনতি। একমাত্র বাংলাদেশেরই ২০১৬ সাল ছাড়া এই সূচকে ধারাবাহিকভাবে প্রতিবছরই অবনতি হয়েছে।

১৪ বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, নেপাল ২০০৯ সালের ১১৮তম অবস্থান থেকে ২০২৩ সালে ৯৫তম অবস্থানে পৌঁছেছে। শ্রীলঙ্কা ১৬২ থেকে ১৩৫তম অবস্থানে, পাকিস্তান ১৫৯তম অবস্থান থেকে ২০২৩ সালে ১৫০তম অবস্থানে আছে। ভুটানের সূচক অবনতি হয়ে ৭০তম অবস্থান থেকে ২০২৩ সালে ৯০তম অবস্থানে পৌঁছেছে। ২০০৯ সালে মালদ্বীপের অবস্থান ছিল ৫১তম। ২০২২ সালে তা ৩৬ ধাপ পিছিয়ে হয়েছে ৮৭তম। এ বছর দেশটির অবস্থান ১০০তম।

২০০৯ সালে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে আফগানিস্তানের অবস্থান ছিল ১৪৯তম। ২৭ ধাপ উন্নতি করে ২০২১ সাল দেশটি ১২২তম অবস্থানে আসে। কিন্তু ২০২১ সালের ১৫ আগস্ট তালেবান আবার ক্ষমতা দখলের পর ২০২২ সালে আফগানিস্তান ১৫৬তম অবস্থানে পৌঁছে। এ বছর দেশটির অবস্থান ১৫২তম। এই ১৪ বছরে দক্ষিণ এশিয়ায় মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে সবচেয়ে অবনতি হয়েছে প্রতিবেশী ভারতের। ২০০৯ সালে দেশটির অবস্থান ছিল ১০৫তম। ২০২২ সালে দেশটির অবস্থান ছিল ১৫০তম। এ বছর দেশটির অবস্থান ১৬১তম।

বাংলাদেশে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে তথ্য নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে বলে মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর ও সুইডেনের গথেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্যারাইটিস অব ডেমোক্রেসির (ভি-ডেম) সদ্য সাবেক ভিজিটিং রিসার্চার অধ্যাপক আলী রীয়াজ

তিনি বলেন, ‘২০০৯ সাল থেকেই বর্তমান সরকারের লক্ষ্য ছিল শাসন কাঠামো পরিবর্তন করে ফেলবে। এক ধরনের রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তৈরি করবে। এই নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা থেকে ক্রমাগতভাবে গণমাধ্যমের ওপর চাপ বাড়তে থাকে। ২০১১ সালের পর থেকে এই চাপ আরও বেশি করে বাড়তে থাকে। কারণ ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনী হওয়ার পর তখন সরকার নিশ্চিত হয় যে কোনোভাবেই বিরোধী দলের আর জেতার সুযোগ থাকবে না। দলীয় সরকারের আমলে কখনই দেশে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। দেশে গণতন্ত্রের ক্ষয় হলে গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হয়। প্রথমে সাংবিধানিক পরিবর্তন করা হয়, তারপর বিরোধী দলগুলোর ওপর এবং গণমাধ্যমের ওপর চাপ তৈরি করা হয়। তখন থেকেই দেখতে পাই গণমাধ্যমের ওপর আইন ও আইনের বাইরে চাপ প্রয়োগ করা হয়।’

গণতন্ত্র না থাকলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা থাকে না উল্লেখ করে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘যে দেশে রাজপথে কথা বলা যায় না, সেই দেশে লিখে কথা বলা যাবে না, এটাই স্বাভাবিক। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস হওয়ার পর বাংলাদেশে ফেসবুকে লাইক দেওয়াটাও ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করেই শাসন চালানো হচ্ছে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা বলতে হলে আমাদের গণতন্ত্রের কথা বলতে হবে। নির্বাচনের কথা বলতে হবে, সমাবেশ করার অধিকারের কথা বলতে হবে। নাগরিকের অধিকার না থাকলে সাংবাদিকের স্বাধীনতা থাকবে না।’

সরকারের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবেদন গেলে অধিকাংশ সময় সেই প্রতিবেদনকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও মনগড়া প্রতিবেদন মনে করে তা প্রত্যাখ্যান করা হয়। এটি কেন হয়? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দেখুন, কে কী বলল সেটাতে কিছু যায় আসে না। আমরা তো বাস্তবে দেখতে পাচ্ছি দেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নেই। গণতন্ত্র নেই। এটাই তো সত্য। কেউ প্রতিবেদন দিলো কি না, সরকার সেটি মানল কি না, সেটাতে কোনোকিছু যায় আসে না। আমরা তো নিজেরাই প্রকৃত দৃশ্য দেখতে পাচ্ছি।’

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশের যে অবস্থান, সেটি বিব্রতকর বলে মনে করি। এই সূচকে যে কয়েকটি বিষয় দেখা হয়, তার মধ্যে একটি সাংবাদিকদের নিরাপত্তা। এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্কোর একেবারই কম। সাংবাদিকতা পেশা যে বাংলাদেশে নিরাপত্তাহীন, সেটিই এর মাধ্যমে প্রমাণিত হয়। আর এটা খুব সহজে অনুমেয় যে এর অন্যতম কারণ হলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। এই আইনের মাধ্যমে হুমকির পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে।’

‘আরেকটি বিষয় হলো, আমরা কাদের চেয়ে সামান্য উপরে আছি এবং কাদের থেকে নিচে আছি। যুদ্ধবিধস্ত এবং অনেক বেশি স্বৈরতান্ত্রিক এমন দেশগুলোর উপরে আছি আমরা। আমরা দাবি করি আমরা এমন দেশ না। তাহলে কেন আমাদের এই অবস্থা হবে? নিরাপত্তাহীনতার কারণ কী সেটি আমাদের বিশ্লেষণ করতে হবে। সরকার পরিচালনায় একচেটিয়া প্রভাবের কারণে গণমতকে নিরুৎসাহিত করা হয়, নিয়ন্ত্রিত করা হয়। আমরা গণমাধ্যম সূচকে যে অবস্থানে আছি, সেখান থেকে পরিত্রাণের জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করতে হবে। রাজনৈতিক-সংস্কৃতির পরিবর্তন আনতে হবে। গণতান্ত্রিক চর্চা থাকতে হবে’, যোগ করেন তিনি।

মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশের অবনতির পেছনে মূলত ২টি বিষয় দায়ী বলে মনে করেন সাংবাদিক নেতা মনজুরুল আহসান বুলবুল। ‘একটি স্টেট অ্যাক্টর, আরেকটি নন-স্টেট অ্যাক্টর। আমাদের গণমাধ্যমের সঙ্গে স্টেট এবং নন-স্টেট সবার ভালোবাসা-ঘৃণার সম্পর্ক। গণমাধ্যম পক্ষে কথা বললে ধন্যবাদ দেয়, হাততালি দেয় এবং সমালোচনা করলে বিপক্ষে অবস্থান নেয়। মালিকানাও একটি বড় বিষয় এখানে। পেশাদারিত্বের উৎকৃষ্টতার জায়গায় আমরা পিছিয়ে আছি। এবার সূচকে পেছানোর বড় কারণ হলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার। আইনটি হওয়ার সময় আমরা কিছু ধারা নিয়ে বিরোধিতা করেছিলাম, এখনো করছি।’

১৪ বছরে মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশের ৪২ ধাপ পেছানোর বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখছেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘রাজনীতিতে যদি সহনশীলতা না থাকে, তার প্রভাব তো সংবাদমাধ্যমগুলোতে পড়ে। আমাদের মিডিয়ার মধ্যে অরাজক অবস্থা আছে। পরিচ্ছন্ন রাজনীতি না থাকলে পরিচ্ছন্ন মিডিয়াও পাওয়া যায় না। পরিচ্ছন্ন রাজনৈতিক শক্তি কেবল পরিচ্ছন্ন গণমাধ্যম তৈরি করতে পারে।’

বর্তমান সরকারের আমলে অনেক গণমাধ্যম লাইসেন্স পেয়েছে। সরকার বলে থাকে তারা গণমাধ্যমবান্ধব। এই সংখ্যা দিয়ে কি গণমাধ্যমের স্বাধীনতা মাপা যায়? প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘প্রশ্নই ওঠে না। সংখ্যার বিচার দিয়ে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বিচার হয় না। যাদেরকে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে, সেই বিষয়গুলো গবেষণা করলে তাদের সঙ্গে সরকারের রাজনৈতিক সম্পর্ক হয়তো বের করা যাবে।’

বর্তমান সরকারের শাসনামলে মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশের অবনতির বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক তথ্যমন্ত্রী ও বর্তমানে তথ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘যারা এই সূচক প্রকাশ করে, তারা কোনো স্বীকৃত সংগঠন না। তারা তাদের ইচ্ছেমতো এই সূচক তৈরি করে। আমার জানামতে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, আইন-কানুন এবং সাংবাদিক সংস্থা, মালিক সংস্থা তাদের সঙ্গে কথা না বলে তারা এই সূচক তৈরি করে থাকে। আমি সাড়ে ৬ বছর তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলাম। এই সময়ে তথ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ না করেই তারা রিপোর্ট দিয়েছে। এসব সংস্থার রিপোর্ট আমার কাছে বিভ্রান্তিকর মনে হয় এবং সঠিক চিত্রের প্রতিফলন মনে হয় না।’

আপনি কি মনে করেন দেশের গণমাধ্যম এখন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে, সরকারের পক্ষ থেকে কোনো বাধা নেই? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দেশের গণমাধ্যম স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষেত্রে এখনো কিছু সমস্যা আছে। রাষ্ট্র, প্রশাসন, করপোরেট হাউস, মালিকপক্ষ, দুর্নীতি, সিন্ডিকেট, জঙ্গি-সন্ত্রাসীর পক্ষ থেকে গণমাধ্যমের ওপর সংকোচনের একটি চাপ আছে। এর সঙ্গে কিছু আইন-কানুনের অপপ্রয়োগ ও ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি ও অপপ্রয়োগের কারণে কিছুটা বাধা আছে। তারপরেও কিন্তু বাংলাদেশে সাংবিধানিকভাবে গণমাধ্যমকে সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে। তবে আমার পরামর্শ হচ্ছে, আইনের যেসব ধারার কারণে গণমাধ্যমের ওপর চাপ আছে, সেগুলো সংশোধন করা।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*