DON'T MISS
Home » UK NEWS » Bangladesh politics » পুলিশ ছাত্রলীগ ফ্রেন্ডলি ফাইট ও অতঃপর

পুলিশ ছাত্রলীগ ফ্রেন্ডলি ফাইট ও অতঃপর

কেন্দ্রীয় দুই ছাত্রলীগ নেতা নাঈম ও মুনিমকে শাহবাগ থানায় বেধড়ক পেটানো, দাঁতে উপড়ে ফেলার ঘটনায় এখন তোলপাড় চলছে পুলিশ প্রশাসনে, সরকারি দলে এবং অবশ্যই মাধ্যম ও সামাজিক সমাজে। ভুক্তভোগী ছাত্রলীগ নেতাদের অভিযোগ, রাষ্ট্রপতির এপিএস আজিজুল হক ওইদিন সন্ধ্যায় ছাত্রলীগের তিন নেতাকে ডেকে নেন। তিনি বারডেম হাসপাতালে তার স্ত্রীর সঙ্গে এডিসি হারুনকে দেখতে পেয়ে বাগবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন। পরে পুলিশ ছাত্রলীগ নেতাদের শাহবাগ থানায় ডেকে নেয় এবং সেখানে তাদের বেদম মারধর করা হয়।

থানায় আটকে ছাত্রলীগ নেতা পেটানোর দায়ে রমনা জোনের এডিসি হারুনকে নিয়ে চলছে নাটকের পর নাটক। প্রথমে হারুনকে দায়িত্ব থেকে সরানো হয়, পরে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নে বদলি করা হয়, ছাত্রলীগ নেতারা পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে দেখা করার পর সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। সাময়িক বরখাস্ত করাতে পারায় ছাত্রলীগ নেতাদের উচ্ছ্বাস বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি কারণ হারুনকে পুলিশের রংপুর রেঞ্জে সংযুক্ত করে আদেশ জারি হয়েছে এর মধ্যে। অর্থাৎ হারুনের কোনো শাস্তি তো দূরের কথা, তাকে বদলি করে নিরাপদ করা হয়েছে। এভাবে তুলে এনে মারধর করা ফৌজদারি অপরাধ, কিন্তু ছাত্রলীগ একটি মামলা পর্যন্ত করতে সাহস করেনি।

ছাত্রলীগের সঙ্গে ‘ফ্রেন্ডলি ফাইট’-এর পর হারুন সম্পর্কে এখন অনেক কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু এই অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (এডিসি) হারুন-অর-রশীদের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ অনেক আগে থেকেই। গত কয়েক বছরে এডিসি হারুন তার সহিংস আচরণের বহু নজির রেখেছেন। ছাত্র, শিক্ষক, সাংবাদিক, বিরোধী দলের সদস্যসহ যারা কোনো পাবলিক ইস্যু নিয়ে কথা বলতে রাস্তায় নেমেছেন, তিনি তাদের ওপর হামলা করেছেন। গত বছর ঠিক এ সময়ের পত্রিকা ঘাঁটলেও এরকম দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে। তার মাত্রাতিরিক্ত এবং অনিয়মতান্ত্রিক বলপ্রয়োগের বিষয়টি সরকার বা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নজরে আনা হলেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এবারও হলো না।

nagad

ঘটনার ব্যাখ্যা যার যার মতো করে দিচ্ছেন এখন। মহানগর গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান হারুন অর রশীদ বলেছেন, এডিসি হারুনের ওপরই আগে হামলা হয়েছে যদিও তার সঙ্গে একমত হননি পুলিশ কমিশনার। প্রশ্ন হলো, হামলা হলেও কি এডিসি হারুন এমন করে একজনকে পেটাতে পারেন? অপরাধীর তো বিচার পাওয়ার অধিকার আছে এবং সেটা যদি পুলিশ নিজ হাতে সম্পন্ন করে ফেলে তাহলে দেশে আইন বা বিচারিক পদ্ধতি থাকার প্রয়োজন কী?

হারুনের কোনো শাস্তি হবে বলে মনে হচ্ছে না। এর মধ্যেই তার বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার করে রংপুরে বদলি করা হয়েছে এবং ধীরে ধীরে এ আলোচনা মিইয়ে যাবে। হারুনের ওপর আগে হামলা হয়েছে বলে বিষয় দুর্বল করে ফেলার চেষ্টা দৃশ্যমান। পুলিশই যদি মামলা (যদিও হয়নি এখনো) দুর্বল করে দেয়, তবে ন্যায় মিলবে কীভাবে? এ ঘটনার পর যদি হারুনের শাস্তি না হয়, তাহলে তা হবে পুলিশের দায়বদ্ধতার অভাবের দৃষ্টান্ত। বলতে হবে এই বিভাগ নিপীড়ন করতে অভ্যস্ত।

এ আক্ষেপ বহুবার, নানা ঘটনার মাধ্যমে দেশের নাগরিকরা অনুভব করছে। প্রতাপশালী পুলিশ আর রাজনৈতিক নেতৃত্বের যুগলবন্দি বিচারব্যবস্থাকে প্রহসনে পরিণত করে থাকে। এ ঘটনায় শাসক দলের ছাত্রসংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতা নির্যাতিত হওয়ায় প্রত্যাশা ছিল কিছুটা হলেও বিচারের বাণী সরব হবে।

পুলিশের বহু কর্মীর ভেতরই নীতি-নিষ্ঠা আছে। সব পুলিশকর্মী নিপীড়কও নয়। কিন্তু মানুষ জানে মন্দ ব্যবস্থায় ভালো পুলিশ হতে পারে না। নাগরিকের আস্থা বজায় রাখতে পুলিশে সংস্কার আনার কথাটাই বারবার উচ্চারিত হচ্ছে। এ কথা আমরা জানি যে, প্রয়োজনে পুলিশকে কঠোর হতেই হয়, বিশেষ করে যারা আইন মানতে চায় না, যারা দাগি অপরাধী, তাদের সঙ্গে। আবার রাজনৈতিক কারণে পুলিশ ব্যবহৃত হয়, সেটাও সবার জানা। কিন্তু সবসময় প্রত্যাশা থাকে, পুলিশ জনতার বন্ধু হিসেবে কাজ করবে, কারণ যে কোনো বিপদে প্রথম মানুষ পুলিশের কথাই ভাবে, তাদের কাছেই যাওয়ার চেষ্টা করে। সেখানে গিয়ে ভালো ব্যবহার আর সাহায্য না পেলে মানুষ হতাশ হয়। মানুষ সরকারের বিভিন্ন সেবা প্রতিষ্ঠান থেকেই বঞ্চিত হয়, কিন্তু পুলিশ যেহেতু অনেক দৃশ্যমান, তাই এ বাহিনীর নেতিবাচক কোনো কিছু নিয়ে আলোচনা অনেক বেশি হয়।

পুলিশ সম্পর্কে নানা খবর পড়তে গিয়ে কয়েক বছর আগের একটি খবর চোখে পড়ল। পুলিশের এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, জনগণ যেন পুলিশ বাহিনী থেকে কাঙ্ক্ষিত সেবাটা পেতে পারে, সেজন্য আমরা পুলিশকে আধুনিক ও জনবান্ধব করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জনের মধ্য দিয়ে যে কোনো ধরনের দমন করা সহজ এবং সেই দৃষ্টিকোণ থেকে পুলিশ কাজ করবে, সেটাই আমার প্রত্যাশা।

পুলিশের মহাপরিদর্শকসহ ওপরের স্তরের কর্তারা এ কথা প্রায়ই বলেন যে, তারা তাদের কর্মীকে জনবান্ধব করে গড়ে তুলতে চান। মানুষও সেটাই চায়। কিন্তু সেটা কী করে হবে, তা বলা খুব কঠিন। এখানে চলে আসবে পুলিশ-জনতার সংখ্যানুপাত প্রসঙ্গ, পুলিশের লজিস্টিকস বাড়ানো, সুযোগ-সুবিধা আরও বাড়ানোর বিষয়গুলো। চাহিদা ও রাষ্ট্রীয় সামর্থ্য বিবেচনায় এগুলো একটা প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে করতে হয়। কিন্তু মনস্তত্ত্বের জায়গা থেকে একটা কথা বলতে পারি এবং সেটা খুব কঠিন নয় বলেই ধারণা করি। এর জন্য সুযোগ-সুবিধা বা লজিস্টিকসও বড় উপকরণ নয়। আমরা এমন একটা দিন চাই যেদিন থেকে আমরা সবাই জানব, থানা হবে সেবার কেন্দ্রবিন্দু, যেখানে সাধারণ মানুষ নির্ভয়ে যাবে, সেবা নিয়ে বের হবে হাসিমুখে।

পুলিশ বেশি সমালোচিত হয়, কারণ পুলিশের কাজ মানুষের ব্যক্তিগত স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত। তাই এ বাহিনীর একজনও যদি কোনো অন্যায় বা নিয়মবহির্ভূত কিছু করেন, তার প্রভাব অনেক বেশি হয়। কেউ যদি অন্যায়ভাবে আটক হয়, কোনো কাজে পুলিশের সামান্যতম বিচ্যুতিও মানুষকে রাগান্বিত করে। একটা কথা মনে রাখা দরকার, মানুষের স্বাধীনতা খর্ব করার জন্য পুলিশকে অধিকার দেওয়া আছে ন্যায়সংগত আইনি উপায়ে। কিন্তু সবসময় যে ন্যায়সংগত উপায়ে সেটা হয়, তা বলা যাবে না এবং সে কারণেই সমালোচনা হয় ব্যাপকভাবে।

পুলিশের মানবিক-অমানবিক মুখ নিয়ে এত চর্চা, তার আঁচ কি কখনো পৌঁছে ওপরতলার কর্তাদের হৃদয়ে? পুলিশ অর্থেই অমানবিক বা অত্যাচারী নয়। অসংখ্য পুলিশকর্মী আছেন, যারা এর উল্টো পথের পথিক, সমাজ তাদের কুর্নিশ জানায়। কিন্তু মানবিকতার চর্চা সহজ নয়। সেটা অর্জন করতে হয়। পুলিশের হাতে আছে অবাধ ক্ষমতা। এ ক্ষমতার স্বাদ পাওয়া প্রতিটি কর্মীরই মেধা ও শ্রমের চর্চার মধ্য দিয়ে মানবিকতা চর্চার দিকে যাওয়া দরকার। সেখানে রাজনৈতিক নেতৃত্বেরও দায় আছে। রাজনৈতিক স্বার্থে পুলিশকে অতিরিক্ত ব্যবহার করে তাকে জনগণের বিপক্ষ শক্তি বানায় রাজনীতিই।

সমস্যাটা গভীর। একদিকে রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে গণতন্ত্র, ব্যক্তি-স্বাধীনতা, জনকল্যাণ, ন্যায়, যুক্তি আর নীতির প্রতি অটল থাকার জন্য। অন্যদিকে বিদ্বেষ আর বিভাজনে পূর্ণ রাজনীতি পুলিশকে ব্যবহার করে আসছে সেই রাজনীতি প্রতিষ্ঠায়। পুলিশের অত্যাচারের খুঁটিনাটি এখন আর গোপন থাকে না। আধুনিক প্রযুক্তির দৌলতে এখন আনেক কিছুই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

পাবলিকের সঙ্গে আচরণে সবকিছু শেষ পর্যন্ত পুলিশের পক্ষে যায়। কারণ রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং পুলিশ নিজে এটা প্রমাণ করে ছাড়ে যে, যা কিছু হয়েছে বিধিসম্মতভাবেই হয়েছে। নাগরিকের আত্মরক্ষার অধিকার স্বীকৃত সংবিধানে, তবে তা মানে কে? প্রকৃত অর্থে এ দেশে সাধারণ মানুষের আত্মরক্ষার অধিকারের জোরালো কোনো আইনি ভিত্তিই তৈরি হয়নি। বিষয়টা নিয়ে ভাবা দরকার। কেউ বলছে না যে পুলিশের ক্ষমতা কাটছাঁট করতে হবে। কিন্তু মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা এবং আইনের প্রতি শ্রদ্ধা তো জাগ্রত রাখতে হবে। পুলিশের বিধিবিধান আর নাগরিকের আত্মরক্ষা নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা বড় জরুরি হয়ে পড়েছে।

লেখক : প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*