নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রথম রঙিন ও সিনেমাস্কোপ ছবির চিত্রগ্রাহক আফজাল এইচ চৌধুরী। সপ্তাহের বেশি চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় গত বৃহস্পতিবার ৯২ বছর বয়সে মারা যান তিনি (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। দুই সন্তান দেশের বাইরে থাকায় কাল রোববার ভোর পর্যন্ত তাঁর মরদেহ বারিধারা ডিপ্লোমেটিক জোনের বাড়ির সামনে হিমায়িত গাড়িতে রাখা হবে। এরপর সকালে তাঁকে বহনকারী গাড়িতে জন্মস্থান সিরাজগঞ্জে নিয়ে যাওয়া হবে। শেষবারের মতো জন্মস্থানে যাবেন ক্যামেরার কারিগর। শহরের বাজার স্টেশন কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হবে বলে জানান স্ত্রী সুরাইয়া আফজাল।
আফজাল এইচ চৌধুরীর সহধর্মিণী জানান, কয়েক বছর ধরে নানা ধরনের শারীরিক সমস্যায় ভুগছিলেন তিনি। ২৪ আগস্ট নিউমোনিয়ার সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। কয়েক দিন চিকিৎসার পর তিনি মারা যান।
ছোটবেলা থেকেই ফটোগ্রাফি করতেন আফজাল এইচ চৌধুরী। চলচ্চিত্রে কাজ করার ইচ্ছা থেকে ১৯৫০ সালে বোম্বে যান তিনি। সেখানে বিখ্যাত চিত্রগ্রাহক ভাই জাল মিস্ত্রি ও ফলি মিস্ত্রির সঙ্গে কাজ শুরু করেন। এরপর লাহোর ও করাচিতে কাজ করেন। খান আতাউর রহমানের মাধ্যমে আফজাল এইচ চৌধুরীর খোঁজ পান জহির রায়হান। ১৯৬২ সালে জহির রায়হানের একটি চিঠি পেয়ে করাচি থেকে ঢাকায় আসেন তিনি। এরপর তাঁর পরিচালিত ‘কাঁচের দেয়াল’ চলচ্চিত্রের চিত্রগ্রহণের কাজ করেন।
এটিই তৎকালীন ঢাকায় তাঁর চিত্রায়িত প্রথম চলচ্চিত্র। একই বছর তিনি সুরাইয়া আফজালের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। পরে জহির রায়হানের পরিচালনায় ‘জীবন থেকে নেওয়া’ ‘সঙ্গম’, ‘বাহানা’, ‘আয়না’র মতো চলচ্চিত্রের কাজ করেন। আশির দশকের মাঝামাঝি মমতাজ আলীর সঙ্গেও কয়েকটি চলচ্চিত্রে চিত্রগ্রাহকের কাজ করেন। এরপর আর কোনো চলচ্চিত্রে কাজ করেননি তিনি।
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, তৎকালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের প্রথম আংশিক রঙিন ‘গুলে বাঁকালি’ (১৯৬১)–তেও কাজ করেন। চিত্রগ্রাহক আফজাল এইচ চৌধুরীর জন্ম ১৯৩১ সালের ৩১ অক্টোবর সিরাজগঞ্জে। জন্মের ১ মাস ২২ দিন পর মা আমেনা খাতুন মারা যান। এরপর মায়ের বোনকে বিয়ে করেন আফজাল এইচ চৌধুরীর বাবা আবদুল ওয়াহাব চৌধুরী। অল্প বয়সে রংপুরের মহিমাগঞ্জে মামির কাছে পাঠিয়ে দেন তাঁর বাবা। স্কুলের শুরুটা সেখানেই। ক্লাস থ্রি পর্যন্ত পড়ে সিরাজগঞ্জের জ্ঞানদায়িনী স্কুলে ভর্তি হন। এরপর বিএল হাইস্কুলে থেকে এসএসসি শেষ ১৯৪৮ সালে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। পরে পড়াশোনার পাশাপাশি নিজেকে ফটোগ্রাফিতেও ব্যস্ত করে তোলেন।
আসাদুজ্জামান নূরকে দেওয়া দেশ টিভির এক সাক্ষাৎকারে আফজাল এইচ চৌধুরী জানান, স্কুলে পড়ার সময় পত্রিকায় একটি বিজ্ঞাপন দেখেন, কোডাক কোম্পানি ৬ টাকা ১২ আনায় একটা বক্স ক্যামেরা বিক্রি করবে। তার সঙ্গে একটা রোল ফিল্ম দেবে। ভাইয়ের কাছে টাকা চেয়ে কিনে নেন সেটি। এরপর ওই ক্যামেরা দিয়ে ভাই–ভাবিদের ছবি তোলা শুরু করেন। স্কুলে থাকা অবস্থায় ফটোগ্রাফির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন।
পরিবারও তাঁকে সাপোর্ট করতেন। আর ক্লাস টেনে পড়ার সময় কলকাতায় গিয়ে দামি ক্যামেরা কিনে আনেন। এরপর পরিবারের সবার ছবি তোলার জন্য ডাক পড়ত।
সাক্ষাৎকারে আফজাল এইচ চৌধুরী বলেন, বোম্বেতে ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’ থেকে ওই সময় একটা ম্যাগাজিন বের করত ‘ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অব ইন্ডিয়া’। ওখানে চিলড্রেনস কর্নার বলে একটা পেজ থাকত। নিজের ভাগনের একটা ছবি তুলে পাঠিয়ে দেন। কিছুদিন পর দেখেন তাঁর তোলা ছবিটি পুরস্কার পেয়ে যায়। ১৯৪৮ সালে ঢাকা কলেজে ভর্তির পর আগস্টে এক সরকারি অনুষ্ঠানে পরিচালক এ জে কারদারকে (জাগো হুয়া সাভেরা) দেখেন ১৬ মিলিমিটার ক্যামেরায় ছবি তুলছেন। তাঁর ছবি তোলা দেখেই ভাবেন, সিনেমার ক্যামেরার কাজ শিখতে হবে। এরপর নিজেকে বোম্বে, করাচি হয়ে নিজেকে চলচ্চিত্রের কাজের জন্য তৈরি করেন।