DON'T MISS
Home » UK NEWS » Bangladesh politics » বাংলাদেশে নির্বাচন, ভিসা নিষেধাজ্ঞা এবং রাষ্ট্রদূতের নিরাপত্তা উদ্বেগ

বাংলাদেশে নির্বাচন, ভিসা নিষেধাজ্ঞা এবং রাষ্ট্রদূতের নিরাপত্তা উদ্বেগ

বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। ছবি : সৌজন্য

বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। ছবি : সৌজন্য

সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য বাংলাদেশ সরকারকে চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রেখেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ঢাকাকে চাপে রাখতে ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ করেছে ওয়াশিংটন। নানা প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপের প্রতিবাদ জানিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ সরকার। এর জের ধরেই বাংলাদেশে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত নিজের ও দূতাবাসের কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। 

মার্কিন রাষ্ট্রদূতের এই শঙ্কা প্রকাশ বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার সম্পর্ককে আরও তিক্ত হওয়ার ঝুঁকিতে ফেলেছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে তৈরি হয়েছে নানা দ্বন্দ্ব। 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং তাদের মিত্ররা অবাধ, সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয় জোর প্রদান করছে। কারণ গত দুটি নির্বাচনে (২০১৪ এবং ২০১৮) বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ব্যাপক কারচুপি করে ক্ষমতা দখল করেছে বলে অভিযোগ করছে বড় বিরোধী দলগুলো। প্রধান বিরোধীদল কর্তৃক নির্বাচন বয়কটের ঘটনাও ঘটেছে। তাই আগামী নির্বাচনে গত দুটি নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি না ঘটে এবং সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হয় সে ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বেশ সতর্ক অবস্থানে দেখা যাচ্ছে। 

nagad

বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও এর অংশীদাররা একটি নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি জানিয়ে আসছে। তারা বলছে, দলীয় সরকারের অধীনে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এ দাবি সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছে আওয়ামী লীগ। 

রাজনীতি বিশেষজ্ঞ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ বলেন, ‘আরও একটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন দেশকে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে নতুন এক উদ্বেগজনক যুগের দিকে নিয়ে যেতে পারে। আর এটি ‘বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ক্ষেত্রে সকল সংকটসীমাকে অতিক্রম করবে।’ 

নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসায় এবং উদ্বেগ বাড়তে থাকায় গত ২২ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের ওপর ভিসা বিধিনিষেধ বলবৎ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত ব্যক্তিদের ওপর এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার এক বিবৃতিতে বলেছেন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কিছু সদস্য, ক্ষমতাসীন দল এবং বিরোধীদলের কিছু রাজনীতিক এবং তাদের পরিবারবর্গ এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের জন্য অযোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারেন। মিলার আরও বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন আয়োজনে সমর্থন দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ’। 

যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত ভিসানীতিতে বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দল এবং সরকারি কর্মকর্তারা উদ্বিগ্ন। কারণ, তাদের অনেকেরই ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক স্বার্থ জড়িত। তাদের পরিবার, সন্তান ও আত্মীয়স্বজনদের একটি বড় অংশ যুক্তরাষ্ট্রে পড়ালোখা বা বসবাস করছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতিতে তারা শঙ্কিত। মার্কিন ভিসানীতির প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতারা, দলের কর্মী এবং অন্যরা যুক্তরাষ্ট্রের ওপর মৌখিক এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আক্রমণাত্মক অবস্থান ব্যক্ত করছে। ক্ষোভের বেশিরভাগই কেন্দ্রীভূত হচ্ছে ঢাকায় নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের ওপর। 

সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এবং ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক একটি টেলিভিশন আলোচনায় বলেছেন, ‘পিটার হাসের উচিত আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ইস্যুতে চুপ থাকা অথবা বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যাওয়া।’ তিনি রাষ্ট্রদূতের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক রীতিনীতি লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে বলেছেন, ‘আমরা মনে করি, আমেরিকা কী বলছে না বলছে তাতে আমাদের পাত্তা দেওয়া উচিত নয় এবং প্রয়োজনে মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করা উচিত।’ 

পরবর্তীতে এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে পিটার হাস উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছিলেন, তিনি মার্কিন দূতাবাসের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। তিনি বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ, আমি এখন চিন্তিত, শুধু আমার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়েই চিন্তিত নই, পুরো দূতাবাস এবং দূতাবাসে যারা কাজ করেন তাদের প্রত্যেকের নিরাপত্তা নিয়ে আমি চিন্তিত।’ 

চলতি বছরের মার্চে, অস্ট্রেলিয়া, চীন, ভারত, সৌদি আরব, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য—ছয়টি দেশের রাষ্ট্রদূতদের জন্য অতিরিক্ত নিরাপত্তা প্রটোকল প্রত্যাহার করে নিয়েছিল বাংলাদেশ। তখন সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছিল নিরাপত্তা পরিস্থিতি সন্তোষজনক থাকায় এবং প্রশাসনের কাছে পুলিশ সদস্যের ঘাটতি থাকায় অতিরিক্ত নিরাপত্তা প্রটোকল প্রত্যাহার করা হয়েছে। তবে বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূতদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা এটাই প্রথম কোনো ঘটনা নয়। 

গত ডিসেম্বরে যখন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ঢাকার শাহীনবাগ এলাকায় গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন, তখন পিটার হাস নিজেই গুন্ডাদের মুখোমুখি হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ২০১৮ সালে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্সিয়া বার্নিকাটের গাড়িতে হামলা হয়েছিল ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকায়। ক্ষমতাসীন দলের সমর্থনকারীরা এ হামলা চালিয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। 

মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এক মুখপাত্র নিক্কেই এশিয়াকে এক ই-মেইল বার্তায় বলেছেন, কূটনৈতিক সম্পর্কের ভিয়েনা কনভেনশন অনুসারে একটি দেশকে অবশ্যই তার ভূখণ্ডে অবস্থিত সব কূটনৈতিক প্রাঙ্গণের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে এবং কূটনৈতিক কর্মীদের ওপর যে কোনো আক্রমণ প্রতিরোধে সবধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে। ই-মেইল বার্তায় মুখপাত্র আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে মূল্যায়ন করে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র আশা করে বাংলাদেশ সরকার দেশের সব বিদেশি মিশন এবং এসব মিশনের কর্মীদের নিরাপত্তা বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।’ 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করছে এবং বিরোধীদের প্রতি পক্ষপাত করছে- এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র বলেন, ‘ওয়াশিংটন কোনো বিশেষ দলকে সমর্থন করে না এবং বাংলাদেশের সব পক্ষই একটি অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে অনুষ্ঠানে তাদের ইচ্ছার কথা প্রকাশ করেছে। ‘মার্কিন ভিসানীতি’ এই উদ্দেশ্যকেই সমর্থন করে এবং বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনভাবে তাদের শাসক বেছে নেওয়ার আকাঙ্ক্ষাকে সমর্থন করে। মুখপাত্র আরও বলেন, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ন করে এমন যে কোনো ব্যক্তির ওপর এই ভিসানীতি সমানভাবে প্রযোজ্য। 

অবশ্য অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেছেন, শুধু ভিসানীতিই একটি সুষ্ঠু নির্বাচনী প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করার জন্য যথেষ্ট নয়। তবে ‘ভিসানীতি’র প্রয়োগে এটি পরিষ্কার করেছে যে, বাংলাদেশের নির্বাচন পূর্ববর্তী পরিস্থিতিকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ভিসানীতির প্রয়োগ এটাও স্পষ্ট করে যে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের গণতন্ত্র রক্ষায় কাজ করতে ইচ্ছুক। 

অধ্যাপক আলী রীয়াজ আরও বলেন, ‘মার্কিন ভিসা দেশের সব মানুষের দরকার হয় না, তবে যারা নির্বাচনের পরিবেশ তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ তাদের মধ্যে অনেকের স্বার্থ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জড়িত। তাই মার্কিন ভিসানীতি তাদের প্রভাবিত করবে।’

সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, আগামী নির্বাচন যদি আবারও গত দুটি নির্বাচনের মতো হয় তবে আমাদের ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা আরোপ হতে পারে। যেমনটা হয়েছে মিয়ানমার এবং গণতন্ত্র থেকে দূরে সরে যাওয়া অন্যান্য দেশগুলোর ওপর। এ ছাড়াও তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের নিরাপত্তা উদ্বেগ কমাতে সরকার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’ 

সাইফুল ইসলাম : সাংবাদিক; নিক্কেই এশিয়া থেকে ভাষান্তর : মুজাহিদুল ইসলাম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*